ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ‘আঁতাতের’ অভিযোগ তুলে একযোগে ৩০০ সংসদ সদস্য নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের অভিমুখী বিক্ষোভ মিছিল করতে গেলে প্রায় শতাধিক এমপিকে আটক করে ভারতীয় পুলিশ। আটকদের মধ্যে ভারতীয় লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ তৃণমূল্যের সংসদ সদস্যরা রয়েছেন। গতকাল সোমবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় ইন্ডিয়া জোট। বিহারের এসআইআরও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোটার জালিয়াতির অভিযোগ তুলে গতকাল প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি ছিল বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের। সেই মোতাবেক গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পার্লামেন্ট ভবন থেকে নির্বাচন কমিশন ভবন অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। সেই মিছিলে সরকারের বিরুদ্ধে ‘ভাট চোর, গদি চোরসহ’ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা।
ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচিতে কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, শিবসেনা, ডিএমকেসহ ইন্ডিয়া জোটের প্রায় সব সদস্যদলের সংসদ সদস্যরা রয়েছেন। তারা পার্লামেন্ট ভবন থেকে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় যাওয়ার পথে প্রথমে পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়েন। তখন সেখানে বসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। পরে পুলিশি ব্যারিকেড টপকে যাওয়র চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটক করে। আটকদের মধ্যে রয়েছেন- কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, সঞ্জয় রাউত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দল তৃণমূলের এমপি সুজাতা ঘোষ, মহুয়া মৈত্র, মিতালি বাগসহ প্রায় ১০০ জন এমপি। আটকের পর রাহুল গান্ধী বলেন, ‘এটা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, আমরা ভোটার তালিকার সুষ্ঠুতা চাই, সরকারের অন্যায় মানি না। এই লড়াই রাজনৈতিক নয়, সংবিধান রক্ষার জন্য। তিনি বলেন, সত্য পুরো দেশের সামনে।’ আর প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভাষায়, ‘সরকার ভীত, ওরা জানে মানুষ আর চুপ থাকবে না।’
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া অগণতান্ত্রিক, বিরোধী ভোটারদের বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।’ শশী থারুরও প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচন কমিশনের নীরবতা কি তাদের পক্ষপাতের প্রমাণ নয়? জনগণের ভোটাধিকারের সুরক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার চুরির বিরুদ্ধে এই লড়াই চলবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘বিজেপির কাপুরুষোচিত একনায়কতন্ত্র আর চলবে না।’ দিল্লি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার দীপক পুরোহিত এমপিদের আটক করার কথা নিশ্চিত করলেও কতজনকে আটক করা হয়েছে তা বলতে পারেননি। ইন্ডিয়া জোটের আটক নেতাদের কাছাকাছি থানায় আটক করা হয়। এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এত বড় মিছিল করার অনুমতি নেননি বিরোধী সংসদ সদস্যরা।
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলেছিল ৩০ জন সংসদ সদস্য তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে। কিন্তু ২০০ জনের বেশি মিছিল নিয়ে আসছিলেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কায় আমরা তাদের আটক করি। কয়েকজন এমপি ব্যারিকেডের ওপর দিয়ে লাফিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। তাদেরও আটক করা হয়েছে, বলে জানান ভারতের আরেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার দেবেশ কুমার মহলা। আনন্দবাজার লিখেছে, পুলিশ আটক করে বাসে তোলার সময় ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন মহুয়া মৈত্র, মিতালি বাগ। অসুস্থ হয়ে পড়েন সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদও। তাদের অসুস্থতার খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসেন রাহুল গান্ধী। তিনি পরে বাস থেকে নেমে সমাজবাদী পার্টির অসুস্থ সাংসদকে অন্য গাড়িতে তুলেও দেন। ইন্ডিয়া জোটের সাংসদদের বিক্ষোভ ঘিরে আগে থেকে পার্লামেন্ট ভবনের চারপাশের সড়কে ব্যারিকেড বসিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মোতায়েন করা হয়েছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটার জালিয়াতির অভিযোগ আনাবিরোধীরা বলছে, গত বছর মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে তাদের সন্দেহ। ওই নির্বাচন হয় লোকসভা নির্বাচনের ছয় মাস পর। লোকসভা নির্বাচনে সেখানকার আসনগুলোতে বিজেপি বিরোধীরা বেশি আসন জিতলেও, বিধান সভায় তাদের ভরাডুবি দেখা যায়। ইন্ডিয়া জোট বলছে, বিজেপিকে জেতানোর জন্য নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় কারচুপি করেছে। ইন্ডিয়া জোটের নেতাদের ভাষ্য, লোকসভার পর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তালিকায় ‘অস্বাভাবিক সংখ্যার’ নতুন ভোটারকে যুক্ত করা হয়েছে। এটাই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কমিশনের আঁতাত নিয়ে সন্দেহ বাড়িয়েছে। একই ধরনের অভিযোগ আছে কর্ণাটকে লোকসভা নির্বাচন ঘিরেও। বিহারে বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে নির্বাচন কমিশন যে ভোটার তালিকা ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধনের’ নির্দেশ দিয়েছে তা নিয়েও আপত্তি তুলেছে বিরোধীরা।
ভোটার তালিকার সংশোধনের এ আদেশ সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। আবেদনকারীরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের আদেশ দেওয়ার এখতিয়ারই নেই। এমন সময়ে এ ধরনের আদেশ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছে তারা। বলছে, সংশোধিত ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ারা এত অল্প সময়ে আপিল করে ভোটাধিকার ফেরত পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিরোধীদলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন এ আদেশ দিয়েছে- সেসব ভোটারদের ছেঁটে ফেলতে, যারা মূলত কংগ্রেস ও অন্যান্য বিজেপি বিরোধীদেরই ভোট দিয়ে আসছিলেন। এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় আধার কার্ড বা ভোটার আইডি দেখালেও কাজ হবে না বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা জন্মসনদসহ আরও কিছু কাগজ চেয়েছে। এসব নিয়েও বিরোধীদের প্রশ্ন আছে। আদালত নির্বাচন কমিশনকে তার সংশোধন প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে বললেও প্রকৃত ভোটাররা যেন কোনোমতেই বাদ না পড়ে তা দেখতে এবং বাদ পড়ারা যেন আপিলের পর্যাপ্ত সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে। ভারতের নির্বাচন কমিশন বিরোধীদের সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তাদের সব কাজই স্বচ্ছ এবং তাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। তারা রাহুল গান্ধীর কাছে লিখিত অভিযোগ ও তার সপক্ষে প্রমাণও চেয়েছে।
এদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বলছে, রাহুল ও অন্যবিরোধী নেতারা একটি ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছেন’। ‘রাহুল গান্ধীর যদি সত্যিই নিজের ওপর আস্থা থাকে তাহলে তিনি সেই অবৈধ ভোটারদের নাম দিতে পারেন, যাদের নাম তালিকায় আছে বলে তার দাবি। তা না করতে পারলে এটা স্পষ্ট হবে যে, তার কাছে আসলে কিছুই নেই এবং তিনি যা করছেন, সেটা হলো- রাজনৈতিক নাটক,’ এক্সে দেওয়া পোস্টে এমনটাই বলেছেন বিজেপির নেতা অমিত মালব্য। বিক্ষোভে অজ্ঞান এমপি ভারতে ভোটে কারচুপির অভিযোগে রাজধানী নয়াদিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় অভিমুখে বিরোধী জোটের প্রায় ৩০০ এমপির বিক্ষোভ মিছিল ঘিরে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্তত দুজন এমপি চেতনা হারিয়ে পড়ে যান। পরে রাহুল গান্ধীসহ অন্যান্য এমপিরা তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন এবং গাড়িতে তুলে হাসপাতালের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন।
রাহুল-প্রিয়াঙ্কাদের আটকের কারণ জানাল পুলিশ:
কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী ভোটার তালিকা ইস্যুতে সংসদ থেকে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় পর্যন্ত বিরোধী সংসদ সদস্যরা বিক্ষোভ করছিলেন। এসময় পুলিশ রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে। নয়াদিল্লি পুলিশ দেবেশ কুমার বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন প্রায় ৩০ জন সংসদ সদস্যকে বৈঠকের অনুমতি দিয়েছিল। তবে, সংসদ সদস্যদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কারণে তাদের আটক করা হয়েছে।’ ‘আমরা কথা বলতে পারি না, এটাই সত্য’ বিজেপির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আঁতাতের অভিযোগে রাজধানী দিল্লিতে বিক্ষোভ চলাকালে অন্যান্য নেতার সঙ্গে তাদের আটক করা হয়। আটকের পর রাহুল গান্ধী বলেছেন, আসলে আমরা কথা বলতে পারি না, এটাই সত্য। এই লড়াই রাজনৈতিক নয়। এটি সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। এটি এক ব্যক্তি এক ভোটের লড়াই। তাই আমরা একটি পরিষ্কার ভোটার তালিকা চাই।